অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাবঃ বিমানে যারা মুম্বাই গেছেন, দিনের বেলা মুম্বাই বিমানবন্দরে নেমে থাকলে তাদের অনেকেই হয়ত খেয়াল করেছেন, বিমানটি যখন মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়েটিকে এপ্রোচ করতে থাকে, তখন কিছুটা সময় সাগরের ওপর দিয়ে উড়ে বিমানটি এক সময় মূল ভূখণ্ডের ওপর উড়ে আসে। জানালা দিয়ে নিচের দ্রুত বদলাতে থাকা দৃশ্যপট খেয়াল করলে একসময় দেখা যায় একটি পর্বতমালা। তারপর আপনি যখন দূর থেকে নিচে মুম্বাই শহরের স্কাইলাইন দেখতে পেয়ে মোটামুটি উত্তেজিত এই ভেবে যে কখন দেখতে পাবেন শাহরুখ, সালমান আর অমিতাভদের বাড়িগুলো, বলা তো যায় না দেখা হলেও তো হয়ে যেতে পারে জুহু বিচে অথবা অন্য কোথাও।
তখন হঠাৎই আপনার স্বপ্নের এই জাল বোনাবুনিতে পানি ঢেলে দেওয়া কিছু দৃশ্যের উদয় হবে। মুম্বাইয়ের আধুনিক বিমানবন্দরটির গা ঘেঁষে এশিয়ার বৃহত্তম যে বস্তিটির দেখা আপনি পাবেন, এটি যদি আপনার প্রথম মুম্বাই সফর হয়ে থাকে, তাহলে আপনি আর যা হোক না কেন অন্তত এই ধরনের দৃশ্য দেখার কোনো রকম মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে যে আসেননি তা হলফ করে বলতে পারি। মুম্বাইয়ে খুব বেশি বার যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কিন্তু যতবারই গেছি প্রতিবারই এই দৃশ্য পীড়া দিয়েছে। এবার তাই সুযোগ পেয়ে ফিরতি পথে কলকাতায় এক আড্ডায় প্রসঙ্গটি না তুলে পারলাম না। কারণ, ভারতের আজকের যে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা, যে অগ্রযাত্রার কেন্দ্রে থেকে নেতৃত্বে ভারতের অর্থনৈতিক রাজধানী মুম্বাই, সেই মুম্বাইয়ের সঙ্গে আর যাই হোক এমন বস্তি কোনো হিসাবেই যায় না।
আড্ডায় বসে জানতে পারলাম চমকপ্রদ তথ্য। মুম্বাইয়ের এই বস্তিবাসীদের পুনর্বাসন করে এখানে আধুনিক টাউনশিপ গড়ে তোলার প্রকল্পটি থমকে আছে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের আপত্তির মুখে। তাদের কাছে এটি মুম্বাইয়ের হেরিটেজ। অতএব কোনোভাবেই এই বস্তি স্থানান্তর তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বুঝলাম, কিন্তু সঙ্গে এও বুঝলাম যে মুম্বাইয়ের মতো অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী শহরেও বস্তিতে থাকার মতে লোকের সংখ্যা এখনও নেহায়েত কম নয়। অবশ্য এটি অপ্রত্যাশিতও নয়। যেকোন দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতিতেই একটি সম্প্রদায় যখন অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী হতে থাকে, তখন তাদের সঙ্গে তাল না মিলাতে পেরে সমাজের একটি অংশ পিছিয়ে পরে, যার অবধারিত পরিণতি ধনী আর দরিদ্রের বৈষম্য।
তবে উন্নয়নের একটি পর্যায়ে গিয়ে একটা সময় এই বৈষম্য বিলুপ্ত হয় আর সেই সময়টাতেই আমরা একটি দেশকে উন্নত হিসেবে গণ্য করি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে যে উন্নত বিশে^র নামি-দামি নগরেও ঠিকানাবিহীন বহু মানুষকে ফুটপাতে বসে ভিক্ষা করতে বা রাত কাটাতে হয় তা দেখা আছে আমাদের সবারই। যে চীন আজ নতুন অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চোখ রাঙাচ্ছে, সেই চীনের অর্থনীতির হৃৎপি- সাংহাইয়ের সুউচ্চ অট্টালিকার পাশে বস্তি নিজ চোখে দেখা। আর নিউইয়র্ক, সানফ্রান্সিস্কো কিংবা লন্ডনের ফুটপাতে বাস্তুহীনের দেখা পাননি এমন মানুষ বোধকরি বিরল।
বাংলাদেশ এই মুহূর্তে উন্নয়ন যাত্রায় যে অবস্থানে রয়েছে, তাতে এদেশে ধনী এবং গরিবদের বৈষম্য কিংবা ফুটপাতে ঠিকানাহীন কিছু মানুষ যে বাস্তবতা তা অস্বীকার করার কোনো কারণই নেই। তারপরও মোটা দাগে সম্প্রতি যে পর্যবেক্ষণ তা তুলে ধরার তাগিদ থেকেই এই ভূমিকাটুকু টানা। প্রতি রমজানে এই শহরের একটি চিত্র আমরা যারা এই শহরে বড় হয়েছি তাদের কাছে অতি পরিচিত। প্রতিবছর রমজানের শুরুতেই ঢাকায় ভিক্ষুকদের একটা আধিক্য নজরে পড়ার মতো। রমজানে আপনি ঢাকার যে কোনো সিগন্যালে দাঁড়ানো মাত্র আপনার এসি গাড়িটিকে ঘিরে ধরে ভিক্ষা প্রত্যাশা করবে একদল ভিক্ষুক, এটি আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়।
সারাবছর এই মানুষগুলোকে ঢাকার সিগন্যালে সিগন্যালে দেখা না গেলেও তাদের দেখা মেলে রমজানে। এরা আসলে একদল মৌসুমি ভিক্ষুক, যারা প্রকৃত পক্ষে গ্রামের বাস্তুহীন অতি দরিদ্র মানুষ। প্রতি রমজানে এরা ঢাকা এবং পাশাপাশি দেশের মেট্রোপলিসগুলোয় সিগন্যালে সিগন্যালে ভিড় করে এই মাসটায় বাড়তি কিছু রুজির প্রত্যাশায়। পেশাগত কারণে বছরের বারো মাসই দিনে এবং রাতে ঢাকার সিগন্যাল থেকে সিগন্যালে ঘুরে বেড়াতে হয়। পাশাপাশি সিলেট শহরেও নিয়মিত যাতায়াত। নানা কারণে বছরজুড়েই যাওয়া পরে দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তেও।
এই রমজানে ঢাকা এবং সিলেট, এই দুই শহরে যে লক্ষণীয় পরিবর্তনটি চোখে পড়েছে, তাহলো এই ‘সিজনাল ভিক্ষুকদের’ অনুপস্থিতি। কখনই দাবি করতে চাই না যে বাংলাদেশ থেকে ভিক্ষা নামক পেশাটি বিলুপ্ত হয়েছে। তবে বিশ^াস করি, আমার সঙ্গে যে কোনো মানুষই একমত পোষণ করবেন যে, আমাদের শহরকেন্দ্রিক ভিক্ষুকদের সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই হৃাস পেয়েছে এবং এই রমজানে তাদের সংখ্যাটি বৃদ্ধি পায়নি। এই দ্বিতীয় পর্যবেক্ষণটিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আর দু’দশটি উন্নয়নশীল দেশের মতই বাংলাদেশেও ধনী আর দরিদ্রের যে ফারাক থাকার কথা তা হয়ত আছে, কিন্তু লক্ষণীয় বিষয়টি হচ্ছে এই ফারাকটি আমাদের সমতুল্য অনান্য দেশগুলোর তুলনায় সম্ভবত কম।
অর্থনীতিবিদ নই, তবে পড়ে, জেনে, বুঝে এ বিষয়ে একটি পর্যবেক্ষণ আছে। নিঃসন্দেহে এ দেশে দারিদ্র্য বিমোচনে আর দেশ থেকে অতি দারিদ্র্য প্রায় বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দেয়ায় সরকারের যে বিশাল সোশ্যাল সেফটিনেট, তার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে নানা ধরনের সোশ্যাল সেফটিনেটতো আরও অনেক দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিতেই আছে। তাহলে আমরা বাড়তি এমন কি করলাম যার কারণে আজ আমাদের এই অর্জন? পর্যবেক্ষণে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রায়ণ প্রকল্পটি। মুজিব বর্ষের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন মুজিববর্ষে দেশে আর কোনো গৃহহীন থাকবেন না। তিনি তার সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষায় কোমড় বেঁধে নেমেছেন।
পৃথিবীর সর্বকালের সর্ববৃহৎ আশ্রয়ণ প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন, বাংলাদেশে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমিয়ে আনায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ রেখেছে। আশ্রয়ণ প্রকল্প সম্পর্কে যারা বেশি জানেন না, তাদের জানানোর জন্য দু’একটি প্রসঙ্গ টেনে আনা যেতেই পারে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মতো প্রকল্প এত বড় মাপের না হলেও ছোটোখাটো করে এদেশে এর আগেও বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়েছে। কখনই সফল তো হয়ইনি, বরং কখনো-কখনো দীর্ঘস্থায়ী সংকটের সৃষ্টি করেছে। জেনারেল জিয়ার সময় সমতলের মানুষদের পার্বত্য অঞ্চলে সেটেল করানোর যে ন্যক্কারজনক উদ্যোগ, তা থেকেই পরবর্তীতে পাহাড়ে অসন্তোষ আর শান্তি বাহিনীর সৃষ্টি। এখনও যে পাহাড় মাঝেসাঝেই অশান্ত হয়ে ওঠে এর জন্য একজন ব্যক্তিকে যদি দায়ী করতে হয়, তবে তার নাম জেনারেল জিয়া।
টঙ্গীতে জেনারেল এরশাদের যে এরশাদ নগর সেখানে এখন হারিকেন জালিয়েও মূল বরাদ্দপ্রাপ্ত একজনের হদিসও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। অথচ এসবের বিপরীতে বিশাল সফল শেখ হাসিনা সূচিত আশ্রয়ণ প্রকল্পটি এবং এই সাফল্যের শতভাগ কৃতিত্ব শেখ হাসিনারই। কারণ, তিনি এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে তাঁর কিছু ধ্যান-ধারণার অত্যন্ত সফল প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। আশ্রয়ণ প্রকল্পে যারা বাড়ি পেয়েছেন, এই বাড়িগুলোর দলিল দেয়া হয়েছে স্বামী-স্ত্রী’র যৌথ নামে। মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই হওয়া মাত্র তা যেন পরিবারিক ভাঙনের কারণ না হয়ে দাঁড়ায় আর পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নের এক অসাধারণ উদ্যোগ এটি।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক এক এলাকার মানুষকে এই প্রকল্পের আওতায় অন্য এলাকায় স্থানান্তর করা হয়নি, যা অতীতে প্রতিবারই করা হয়েছে। চরের মানুষকে পুনর্বাসন করা হয়েছে চর এলাকাতেই আর পাহাড়ের মানুষকে পাহাড়েই। এর উল্টোটি করা হয়নি কোনো ক্ষেত্রেই। ফলে, আশ্রয়ণ প্রকল্পে যারা ঠিকানা পেয়েছেন তারা সেখানেই থিতু হচ্ছেন, পুরনো ঠিকানায় ফিরে যাওয়ার কথা মাথায়ও আনছেন না। পাশাপাশি আশ্রয়ণ প্রকল্পে বাসিন্দাদের জন্য পেশাগত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও থাকছে, যাতে তারা তাদের নতুন ঠিকানায় কিছু করে খেতে পারেন।
শেখ হাসিনার এই অসামান্য উদ্যোগটির সুফল যখন পুরো দেশ উপভোগ করছে, ঠিক তখনই নীরবে একটি ঘটনা ঘটেছে, যা মিডিয়ায় আসলেও আসেনি ঠিক সেভাবে, যেভাবে তা আসা উচিত ছিল। অন্তত আমার তেমনটিই মনে হয়েছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মেধাস্বত্বের কপি রাইটটি এখন শেখ হাসিনার। বাংলাদেশের আর কোনো সরকার প্রধান অতীতে নিজের নামে কোনো কপি রাইট করেছেন এমন নজির নেই। শেখ হাসিনা আরও একবার প্রমাণ করলেন যে, তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। আজকের এবং আগামীর প্রজন্মের কাছে একজন মেধাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর এই অনন্য স্বীকৃতিটি ভবিষ্যতে এ দেশে আরও অনেক মানুষকে মেধার চর্চায় উজ্জীবিত করবে এমনটাই প্রত্যাশিত।
লেখকঃ ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সাইন্সেস।
আপনার মতামত লিখুন :