আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্যদিয়ে নারায়ণগঞ্জে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ইতি ঘটেছে বটে, তবে ওসমানীয় দোসর হিসেবে পরিচিতি পাওয়া বন্দরের মুছাপুর ইউনিয়নের মাকসুদ পরিবারে দেখা গিয়েছিল উল্টো চিত্র। ৫ আগস্টের আগে যেমন তারাই ছিলেন সর্বেসর্বা, তেমনই ৫ আগস্টের পর যেন আরও বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল বন্দরের এই রাজাকার পরিবার।
স্থানীয়রা বলছেন, আওয়ামী লীগের পতন ও ওসমান সাম্রাজ্য চূর্ন হওয়ার পাশাপাশি ধুলোয় মিশেছে সন্ত্রাসীদের মাথার তাঁজ বনে যাওয়া হাজী সাহেব খ্যাত আজমেরী ওসমানের রাজত্বও। তবে ৫ আগস্টের পর ভোল পাল্টে নারায়ণগঞ্জের বন্দরে নিজেকে যেন নয়া হাজী সাহেব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে আধিপত্য বিস্তার করে যাচ্ছিল মাকসুদ পুত্র মাহমুদুর রহমান শুভ। বন্দরের মুছাপুর এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসীরা তাকে আজমেরী ওসমানের আদলে সমীহ করে চলেন। পান থেকে চুন খসলেই শুভর ইশারায় চলা অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী ও হোন্ডা বাহিনীর তাণ্ডব চলে প্রকাশ্যে। অস্ত্রধারী এই সন্ত্রাসী বাহিনীর মাথার তাঁজ রাজাকার দৌহিত্র শুভ। মুছাপুরে শুভর রয়েছে একাধিক টর্চার সেল। যেখানে শুভ ও মাকসুদ পরিবারের নির্যাতনের খরগ নেমে এসেছে অসংখ্য মানুষের ভাগ্যে।
এদিকে, বন্দরের ত্রাস হিসেবে পরিচিত সাবেক চেয়ারম্যান ও জাতীয় পার্টির নেতা মাকসুদ হোসেনকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা হত্যা মামলায় গ্রেফতার করা হলেও জামিনে বেড়িয়ে পূনরায় এলাকায় ত্রাসি চালিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের পথে হাটতে শুরু করেছে রাজাকারপুত্র তকমা গায়ে মাখা মাকসুদ চেয়ারম্যান। তার পুত্রের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকলেও এখনো ধরাছোয়ার বাহিরে রয়েছে।
ওসমানদের ছায়ায় বন্দরের মুছাপুর ইউনিয়নসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে আধিপত্য বিস্তার করে চলা এই শুভর বিরুদ্ধে বন্দর থানায় পুলিশ পেটানো সহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায়ে রয়েছে একাধিক মামলা। এমনকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা হত্যা মামলারও আসামী মাকসুদের পুত্র। এরপরও গত ৫ আগস্টের পূর্বে এলাকায় যেমন আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে, তেমনই ৫ আগস্ট দেশের পট-পরিবর্তনের পরও সেই একই কায়দায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে শুভ; এমন অভিযোগ স্থানীয়দের।
জানা গেছে, মাকসুদকে গ্রেফতারের পর তার পুত্র শুভ পলাতক রয়েছে। তবে মাকসুদ ও শুভকে বাঁচাতে ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিচয় দেয়া একটি মহল দৌড়ঝাপ চালাচ্ছে। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ মহানগর যুবদলের আহবায়ক মনিরুল ইসলাম সজল এই বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তব্য দিয়েছেন।
মনিরুল ইসলাম সজল বলেছেন, ‘যারা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারাই আবার ফ্যাসিবাদীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। বন্দর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মাকসুদ হোসেনকে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সময় হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার জন্য বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা তদবির করেছেন। মাকসুদ হোসেন নাকি তাদের দলের বড় ডোনার। সে নাকি এই দলের প্রার্থী হবে। আগে দেখেছি আওয়ামী লীগের ভেতরে রাজাকার ঢুকলে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যেত। এখন দেখছি ওই দলের ভেতরে ঢুকলে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যায়, রাজপথের পরীক্ষিত নেতা হয়ে যায়। আমরা বলতে চাই আপনারা যত অপকর্ম করেন সমস্ত অপকর্মের প্রমান আমাদের কাছে আছে।’
জানা গেছে, শুভর পিতা মাকসুদ হোসেন বন্দরের মুছাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি বন্দর উপজেলার চেয়ারম্যান হন। জাতীয় পার্টির রাজনীতি করা এই মাকসুদ ছিলেন ওসমান পরিবারের অন্যতম ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমানের অনুকম্পায় মুছাপুর ইউনিয়ন পরিষদে বারবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়া এই মাকসুদ ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে রয়েছে রাজাকার তকমা। তবে ওসমানদের ছায়ায় থাকায় সেই তকমা নিয়েও বিগত দিনের রাজনীতিতে বীরদর্পে বিচরণ করেছেন মাকসুদ ও তার পুত্র শুভ। যদিও শেষ সময়ে এসে বন্দর উপজেলার চেয়রাম্যান প্রার্থী হওয়া নিয়ে সেলিম ওসমানের সাথে বিবাদে জড়িয়ে ছিলেন মাকসুদ। পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে ওসমানদের ছায়ায় থেকেও শেষ সময়ে এসে এন্টি ওসমান হিসেবে নিজেকে জাহির করে এবং দুই হাতে অর্থের খেলায় মেতে উপজেলার চেয়রাম্যান নির্বাচিত হন তিনি। সারাদেশের উপজেলা পরিষদ ভেঙ্গে দিলে বন্দরেও চেয়ার হারান মাকসুদ হোসেন।
সূত্র বলছে, পিতার আস্কারায় বখাটে বনে যাওয়া পুত্র শুভ নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক বিতর্কিত এমপি শামীম ওসমানের পুত্র অয়ন ওসমান ও প্রয়াত নাসিম ওসমানের পুত্র আজমেরী ওসমানের ছত্রচ্ছায়ায় বন্দরের মুছাপুরসহ আশপাশের এলাকায় গড়ে তুলেছে একাধিক সন্ত্রাসী বাহিনী। শুভর নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে হোন্ডা বাহিনীও। যারা পান থেকে চুন খসলেই হোন্ডা মহড়া ও অস্ত্রের ঝনঝনানি দেখিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে। এসকল বাহিনীতে রয়েছে অবৈধ অস্ত্রের মজুদ। আধিপত্য বিস্তার, পূর্ব শত্রুতা কিংবা সেক্টর দখলকে কেন্দ্র করে শুভ বাহিনী একাধিকবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়েছে। এমনকি মদ্যপ হয়ে পুলিশের উপরেও হামলা চালিয়ে উদ্ধত্য প্রকাশ করেছে শুভ। ওই ঘটনায় পুলিশ বাদি হয়ে মামলা এবং গ্রেফতারও করা হয়েছিল শুভকে। যদিও জামিনে বেড়িয়ে পূনরায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়ানোর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এদিকে, এলাকায় সন্ত্রাস হিসেবে পরিচিত হলেও মুছাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। প্রতিনিয়ত হোন্ডা মহড়া দিয়ে এলাকায় ঢাক-ঢোলও পেটাতে দেখা গিয়েছিল শুভ ও তার বাহিনীকে। ওই ইউনিয়নে যারা প্রার্থী হতে চেয়েছিলো, তাদের উপর চালানো হয়েছিল নির্যাতনের খড়গ। অপারেশন ডেভিল হান্টে মাকসুদ ধরা পড়লেও তার পুত্র সন্ত্রাসী শুভকেও আইনের আওতায় আনার দাবি স্থানীয়দের।








