নারায়ণগঞ্জের চারটি আসনে বিএনপির দলীয় মনোনয়ন ঘোষণার পর ১ ও ৫ আসনের দুই প্রার্থী ঘিরে চলছে তুমুল সমালোচনা। বিশ্লেষকরাও বলছেন, ওই দুই আসনে ডুবতে পারে ধানের শীষ! কেননা দলের জন্য নিবেদিত, যোগ্য ও বিতর্কহীন একাধিক প্রার্থী থাকাসত্বেও আসন দুটিতে যাদের বেছে নেয়া হয়েছে, তাদের ললাটে রয়েছে ভয়ঙ্কর বিতর্কের তিলক। তারা উভয়েই আওয়ামী লীগ তথা ওসমান পরিবারের ঘনিষ্ঠ লোক হিসেবে সর্বত্রই পরিচিত। এ যেন বিএনপির মলাটে আওয়ামী লীগ তথা ওসমান পরিবারের দুই প্রার্থীকে বেছে নিয়েছে বিএনপি!
ফলে নারায়ণগঞ্জে বিএনপির নিরঙ্কুশ বিজয় নিশ্চিত করতে বিতর্কিত দুই প্রার্থীকে অপসারন ও দলের জন্য নিবেদিত, জনপ্রিয় এবং ক্লিন ইমেজের প্রার্থী বেছে নেয়ার বিকল্প নেই বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বোদ্ধা মহল।
জানা গেছে, গত ৩ নভেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জের পাঁচটি আসনের মধ্যে চারটি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করে বিএনপি। এর মধ্যে রূপগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান ভূইয়া দিপু এবং সদর ও বন্দর থানা নিয়ে গঠিত নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে প্রার্থী করা হয় বিতর্কিত মাসুদুজ্জামান ওরফে মডেল মাসুদকে। মডেল মাসুদ সদ্যই বিএনপিতে যোগদান করেছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগ তথা ওসমান পরিবারের ঘনিষ্ঠ লোক হিসেবে পরিচিত।

অন্যদিকে, মোস্তাফিজুর রহমান ভূইয়া দিপু বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত থাকলেও আওয়ামী লীগের শাসনামলে দলটির প্রভাবশালী এমপি ও মন্ত্রীদের সাথে উঠা-বসা ছিলো তার। একই ভাবে উঠা-বসা ছিলো নব্য বিএনপি হিসেবে পরিচিত মডেল মাসুদেরও। তাদের ছায়ায় থেকে দুজনই প্রসার ঘটিয়েছেন নিজ নিজ ব্যবসা বাণিজ্যের।
তথ্য বলছে, সন্ত্রাসীদের গডফাদার তকমা পাওয়া আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এমপি শামীম ওসমানের একান্তই আজ্ঞাবহ বিএনপি নেতা দিপু ভূইয়া বর্তমানে ওসমান পরিবারের নানা ব্যবসা-বাণিজ্য সহ তাদের জমি ও সম্পদের দেখভাল করছেন। এর মধ্যে ফতুল্লার জামতলা এলাকায় শামীম ওসমানের শাশুড়ির মালিকানা বিশাল জমিতে দিপু ভূইয়া তার ‘গাউছিয়া ডেভেলোপার্স’ নামক রিয়েলস্টেট ব্যবসার অধিনে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়াও একাধিক জায়গায় তাদের সম্পদ রক্ষা ও বিনির্মানের কাজ চালাচ্ছেন দিপু ভূইয়া। এমন একাধিক তথ্য প্রমাণ হাতে এসেছে।
আওয়ামী লীগের পতন হলে দিপু ভূইয়া শামীম ওসমানের স্ত্রী ও সন্তানদের নিজ গাড়ীতে করে সিলেটের ডাউকি সীমান্ত পর্যন্ত পৌছে দিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন, যা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও উঠে আসে।
দিপু ভূইয়ার চাইতে কম যায়নি ৫ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পাওয়া শিল্পপতি মাসুদুজ্জামানও। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে মাসুদুজ্জামান আওয়ামী লীগের তৎকালিন এমপি শামীম ওসমান, তার বড় ভাই ও জাতীয় পার্টির এমপি সেলিম ওসমান এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর নির্বাচনে স্বশরীরে অংশগ্রণ করে ধানের শীষের বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে ছিলেন প্রকাশ্যে। এসকল ছবি ও ভিডিও এখনও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরপাক খাচ্ছে।
উচ্চ পর্যায়ের একটি বিশ্বস্ত সূত্র বলছে, নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো ছিলো শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমানের নিয়ন্ত্রণে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতন হলেও এই সেক্টরগুলো নিজেদের ছায়ায় রাখতে মডেল মাসুদ ও দিপু ভূইয়াকে ব্যবহার করেন শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমান। ফলে ৫ আগস্ট যখন আওয়ামী লীগের পতন হয়, তখন কোনো ধরনের রেজ্যুলেশন ছাড়াই ব্যবসায়ীদের সংগঠন নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন মাসুদুজ্জামান ওরফে মডেল মাসুদ। পরবর্তীতে মডেল মাসুদকে ঘিরে বিতর্ক দেখা দিলে সেখানে ওসমান পরিবারের আরেক বিশ্বস্ত হাতিয়ার দিপু ভূইয়াকে সভাপতি করা হয়। তাদের দুজনের কাঁধে ভর করে নারায়ণগঞ্জে এখনও আওয়ামী লীগ তথা শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমানের অদৃশ্য খবরদারী চলমান রয়েছে।
এছাড়াও, নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের সাবেক এমপি ও সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর সাথে বেশ সখ্যতা ছিলো দিপু ভূইয়ার। গাজীকে ম্যানেজ করেই রূপগঞ্জে রোক দেখানো বিএনপির কর্মসূচি পালন করতো দিপু ভূইয়া। বর্তমানে গোলাম দস্তগীর গাজীর বিভিন্ন ব্যবসা নিরাপদ রাখতে কাজ করছেন এই বিএনপি নেতা। অনেকে তাকে গাজীর প্রার্থী বলেও সম্বোধন করছেন।
এদিকে, আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী গাজী ও ওসমান পরিবারের দোসরের ট্যাগ ছাড়াও রূপগঞ্জে দিপু ভূইয়ার বিরুদ্ধে রয়েছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নানা অভিযোগ। ৫ আগস্টের পর মাদক ও সন্ত্রাসীদের আস্তানা খ্যাত রূপগঞ্জের চনপাড়াসহ আশপাশের অঞ্চলগুলোতে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। মাদক ও বিভিন্ন সেক্টর দখল নিয়ে ঘটিত এই সকল হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত প্রত্যেকেই দিপু ভূইয়ার রাজনীতিতে সক্রিয়।
এর মধ্যে দাউদপুরে এক যুবদল নেতাকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠে দিপু ভূইয়ার লোকদের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে। ভুলতায় ছাত্রলীগের নেতাকে পিটিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দেয়ার পর এক ছাত্রদল নেতাকেও মারধর করা হয়। এ নিয়ে আদালতে মামলা হয়। চনপাড়ায় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী মাদক ব্যবসায়ী শামীম দিপু ভূইয়ার রাজনীতি করলেও তার কৃতকর্মের ফলে তাকে বহিস্কার করা হয়। তারাবো পৌর বিএনপির সাধারন সম্পাদক হাফিজুর রহমান পিন্টু দিপু ভূইয়ার লোক হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজী ও সন্ত্রাসীর অভিযোগ থাকায় তাকে বহিস্কার করা হয়। এছাড়াও সম্প্রতি দিপু ভূইয়ার লোক হিসেবে পরিচিত সন্ত্রাসী শফিকুলকে অস্ত্র-সহ গ্রেফতার করে র্যাব।
ফলে রূপগঞ্জে ক্ষমতায় আসার আগেই দিপু ভূইয়া সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার মিশনে নেমেছিলেন বলে স্থানীয় সাধারণ ভোটারদের মাঝে দৃশ্যমান। তবে ঘুরে ফিরে সেই বিতর্কিত ব্যক্তির হাতেই ধানের শীষের প্রতিক তুলে দেয়ায় বিএনপির রাজনৈতিক নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সেখানকার ভোটারদের মাঝে।
একই ভাবে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে বিএনপির রাজনীতিতে একাধিক যোগ্য ও জনপ্রিয় স্বচ্ছ নেতা থাকতেও আওয়ামী লীগ তথা ওসমান পরিবারের হয়ে কাজ করা নব্য বিএনপি নেতার হাতে ধানের শীষের প্রতিক তুলে দেয়ায় সেখানকার বিএনপি নেতৃবৃন্দ তো বটেই এমনটি সাধারণ ভোটারদের মাঝেও চলছে তুমুল সমালোচনা।
তরুন ভোটাররা বলছেন, বিএনপিকে কেন্দ্র করে গণঅভ্যুত্থানের যেই স্পিহা বিদ্যমান ছিলো, নারায়ণগঞ্জ-১ ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে দলটির ঘোষিত দুই প্রার্থীর ক্ষেত্রে সেই স্পিহার পরিপন্থি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আগামী নির্বাচনের ফলাফলে যা বুমেরাং হয়ে উঠবে বিএনপির জন্যেই।






