নারায়ণগঞ্জ । শুক্রবার
২৪শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
৮ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

অপরাধের জালে সাবিনা: মাদক ব্যবসা পেরিয়ে হলেন হত্যাকারী

ফতুল্লায় নয়ন হত্যাকান্ডে নিহতের দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিনার বিরুদ্ধে উঠে এসেছে বিভিন্ন অপকর্ম। বিভিন্ন পুরুষের সাথে মুঠোফোনের মাধ্যমেই সে ফ্লাটে নিয়ে আসতেন এবং চালাতেন দেহব্যবসা। এ কাজে তাকে বিগত আওয়ামীলীগের সময়ে সহযোগিতা করতো সমাজের বিশেষ কিছু ব্যক্তি ও কতিপয় নেতা। এভাবেই ধীরে ধীরে টাকার উপর লোভ হয়ে আসে সাবিনার। এরপর যুক্ত হয় মাদক ব্যবসায়।

জানা যায় সাবিনার বিরুদ্ধে চুরি ও মাদক মামলাসহ প্রায় ১০টি মামলা রয়েছে এবং সাবিনার হাতেই নির্মমভাবে হত্যাকান্ডের শিকার হয় নয়ন। সাবিনাকে বিয়ের পর থেকে ১ম স্ত্রীর সাথে একটু দুরত্ব হলেও মাঝে মধ্যে যোগোযোগে থাকতেন তিনি। সে সময়ে নয়নের মাদক বিক্রির টাকাগুলো সাবিনার কাছেই রাখিতো। নিহত নয়নের বাবা বলেন,তিন বছর পুর্বে একটি মাদক মামলায় নয়নের জামিনের বিষয়ে উচ্চ আদালতে আমি যাই। কিন্তু সুচতুর সাবিনা উচ্চ আদালতের সেই আইনজীবির কাছে গিয়ে তার কাছে নয়নের মামলার ফাইলটি চাইলে বিজ্ঞ আইনজীবি আমার সাথে যোগোযোগ করে সেই মামলার নথিপত্র সাবিনাকে বুঝিয়ে দেন। মামলায় জামিনের পরিবর্তে উল্টো তিন বছরের সাজা লাগিয়ে আমার ছেলেকে জেলে পাঠান এ সাবিনা। সে সময় সাবিনার কাছে নয়নের দেড় লাখ টাকা রক্ষিত ছিলো। গত মাসের ১৯ তারিখে আমরা নয়নকে জামিনে বের করে নিয়ে আসি।এরপর রক্ষিত সেই টাকা নিয়েই ঝগড়া হলে সাবিনা নয়নকে বলেন যে,সেই টাকা কুমিল্লায় একজনের কাছে জমা আছে। সেই টাকা আনতে কুমিল্লা যাবে এ মর্মেই নয়ন সেদিন সাবিনার বাড়িতে গিয়েছিলো। এ কথাগুলো বলেই অঝড়ে কান্না শুরু করেন নিহত নয়নের বৃদ্ধপিতা।

এদিকে নয়ন জেলে থাকার সময় অন্যতম মাদক ব্যবসায়ী রাসেল ওরফে ঠোঙ্গা রাসেল,চয়ন গেংদের সাথে মাদক বিক্রির সিন্ডিকেটে পুরোপুরি সক্রিয় হয়ে উঠে সাবিনা। তবে একাধিকসুত্রে জানা যায়, একটি হেরোইনের চালান নিয়েই নয়ন-সাবিনা দ্বন্ধ শুরু হয়। বিষয়টি নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় পড়ে যায় সাবিনা। সেই হেরোইনের সাথে যুক্ত ছিলো ঠোঙ্গা রাসেল,সাবিনার জামাতা জহির,চয়নসহ একাধিক মাদক বিক্রেতা।

ঘটনার আগে শুক্রবার বিকেলে সাবিনার জামাতা জহিরের মুঠোফোনে ১ম স্ত্রীর বাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন নয়ন। নয়ন বাসা থেকে বের হয়ে জহিরের সাথে কথা বলে সাবিনার বাড়িতে যান। রবিবারে নয়ন হত্যাকান্ডের পুর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত সাবিনার বাড়িতে অবস্থান করেছেন তিনি। তবে স্থানীয়দের ধারনা টাকা নয় হোরোইনের বড় চালান নিয়েই সাবিনার সহযোগিদের পরামর্শক্রমেই নয়নকে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হতে হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনচ্ছিুক স্থানীয় অনেকে বলেন, নয়ন হত্যাকান্ডের ঘটনায় সাবিনার জামাতা জহিরের নাম না থাকাটাও একটা রহস্যজনক বিষয়। কারন সাবিনার মাদক বিক্রির অন্যতম পার্টনার হচ্ছে জামাতা জহির। নয়নের অনুপস্থিতিতেই অপর মাদক ব্যবসায়ী ঠোঙ্গা রাসেলের সাথে পরকিয়ার সর্ম্পকে জড়ায় সাবিনা। সাবিনার জামাতা জহিরের আপন বড়ভাইও কিন্তু দাপা ও ষ্টেশন এলাকার একজন চিহিৃত মাদক ব্যবসায়ী। তারা আরও জানান,সাবিনার মাত্রাতিরিক্ত অর্থলোভের কারনে বলি হতে হয়েছে নয়নকে।

এদিকে নয়ন হত্যকান্ডে সাবিনা ও তার মেয়ে সুমনা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

শুক্রবার (১০ অক্টোবর) সন্ধ্যায় সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ইয়াসির আরাফাতের আদালতে তারা এ জবানবন্দি দেন।বিষয়টি নিশ্চিত করে নারায়ণগঞ্জ কোর্ট পুলিশের পরিদর্শক কাইউম খান জানান, হত্যার দায় স্বীকার করে সাবিনা ও তার দুই মেয়ে সুমনা বিস্তারিতভাবে হত্যাকান্ডের মূল ঘটনা, জড়িতদের নাম এবং লাশ গুমের চেষ্টার বর্ণনা দিয়েছেন।

পুলিশ জানায়, নিহত নয়ন তিন বছর কারাগারে থাকাকালীন সময়ে তার দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিনার সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্কে জড়ান রাসেল ওরফে ঠোঙা রাসেল। তারা একসাথে ইয়াবা সেবন করতেন। নয়ন কারাগার থেকে বেরিয়ে বিষয়টি জানতে পারলে দাম্পত্য কলহ চরমে ওঠে।

গত ৫ সেপ্টেম্বর সকালে নয়নের সঙ্গে এ নিয়ে তুমুল ঝগড়ার একপর্যায়ে সাবিনাকে মারধর করে মোবাইল ফোন ভেঙে ফেলেন নয়ন। এর আগে সাবিনা অন্য একটি মোবাইল দিয়ে রাসেলকে বাসায় আসতে বলেন। নয়ন বাসা থেকে বের হওয়ার সময় গেটের সামনে রাসেলের সঙ্গে মুখোমুখি হন। তখন দু’জনের মধ্যে ঝগড়া বাধে। এরপর রাসেল ও সাবিনা নয়নকে টেনে ফ্ল্যাটের ভিতরে নিয়ে যায়।

রুমের ভেতরে কালো হাতলযুক্ত স্টিলের লাঠি দিয়ে নয়নের মাথায় একাধিক আঘাত করে অচেতন করে ফেলা হয়। এরপর সুইচ গিয়ার ও ছুরি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করা হয়।হত্যার সময় সাবিনার প্রথম স্বামীর ঘরের দুই মেয়ে সুমনা ও সানজিদা পাশের রুমে ছিল।পরে সাবিনা বড় মেয়ে সুমনাকে নানির বাসায় ও ছোট মেয়ে সানজিদাকে পরিচিতজনের বাসায় রেখে আসে। রাতে সাবিনা ও রাসেল ফের বাসায় ফিরে যায়। পরদিন সন্ধ্যায় রাসেল তার পরিচিত চয়নকে ঘটনাটি খুলে বলে। চয়ন লাশ গুমের আশ্বাস দেয়।তারা দোকান থেকে হ্যাকসো ব্লেড, স্কচটেপ ও ইয়াবা কিনে বাসায় ফিরে আসে। এরপর সাবিনা, রাসেল ও চয়ন তিনজনই লাশের পাশে বসে ইয়াবা সেবন করে। পরে হ্যাকসো ব্লেড দিয়ে নয়নের পা দুটি বিচ্ছিন্ন করে শরীরের অংশ ড্রামে ভরে এবং পা দুটি প্লাস্টিক ও কস্টেপ দিয়ে মোড়ানো অবস্থায় তোষকের ভেতরে লুকিয়ে রাখে।

লাশ ফেলার জন্য তারা জালকুড়ি এলাকা থেকে একটি অটোরিকশা ভাড়া করে দক্ষিণ শিয়াচর মাওয়া মার্কেটের পেছনের ঝোপে ড্রামটি ফেলে আসে। পরে চয়ন সেখান থেকে পালিয়ে যায়।

মঙ্গলবার দুপুরে পুলিশ ড্রামভর্তি লাশটি উদ্ধার করে। পরবর্তীতে ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে নিহতের পরিচয় শনাক্ত হয়। এরপর মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচনসহ জড়িত সাতজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >